স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস

স্বাধীনতা শব্দটির প্রতিশব্দ Liberty. 'Liberty' শব্দটি ল্যাটিন "Liber" থেকে এসেছে। ১

যার অর্থ Free বা স্বাধীনইচ্ছা অনুযায়ী কিছু করা বা বলার ক্ষমতা কে স্বাধীনতা বলা হয়। মন মতো কোনো কিছু করা বা না করার অধিকার কে বোঝায।এই দৃষ্টিকোণ থেকে অধীনতামুক্ত অবস্থাই স্বাধীনতা।তবে কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রনহীন স্বাধীনতা অরাজকতা ও উশৃঙ্খলতায় নামান্তর।

Herbert Spencer বলেন,

  • · "Every man is free to do whatever he wills,provided he   infringes not the equal freedom of any other man."

অর্থাৎ স্বাধীনতা বলতে খুশিমতো কাজ করাকে বুঝায় যদি উক্ত কাজ দ্বারা অন্যের অনুরূপ স্বাধীনতা উপভোগে বাধার সৃষ্টি না হয়।

T.H Green বলেন,

  • ·  "Freedom consists in a positive power or capacity of doing or enjoying something worth-doing or worth enjoying."

যা উপভোগ করার এবং সম্পন্ন করার যোগ্যতা ও উপভোগ করার ক্ষমতাকে স্বাধীনতা বলে।

Shelly বলেন,

  • ·     "Liberty is the opposite of over government "

অর্থাৎ অতি শাসনের বিপরীত অবস্থা হল স্বাধীনতা।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস,বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯৪৭-১৯৭১,সংক্ষেপে বাংলাদেশের ইতিহাস,স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এসাইনমেন্ট,মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

পরাধীনতায় স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য বোঝা যায়। সবাই স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়।

তাই তো রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় বলেন,

" স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়?"

আসলে বন্ধী বা পরাধীনতার তিক্ত স্বাদ কেউ নিতে চায় না। পিঞ্জরায় বন্ধী পাখির মনে,  চোখে-মুখে সর্বদাই মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন বিরাজ করেআমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। এটিই আমাদের মাতৃভূমি আমরা যে বর্তমানে স্বাধীন দেশে বসবাস করছি তা একসময় পরাধীন ছিল। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই অর্জনের পিছনে রয়েছে গভীর আত্মত্যাগের ইতিহাস, অবিশ্বাস্য সাহস ও বীরত্বের ইতিহাস।

ব্রিটিশরা এই অঞ্চলটিকে প্রায় ২০০বছর শাসন করেছে। তাদের হাত থেকে স্বাধীনতার জন্য হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে, জেল খেটেছে, দ্বীপান্তর গিয়েছে।বাজেয়াপ্ত হয়েছে অনেক বই

১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট রাতে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র। তবে পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান, এর মাঝখানে হলো একটি দেশ ভারত।পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে শুধু দু'হাজার কিলোমিটারের রাস্তার দূরত্বই নয় দূরত্ব রয়েছে চেহারা, ভাষা, খাবার,পোশাক,সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদিতে। একটিমাত্র দিক থেকে মিল ছিল।আর তা হলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা।  অর্থাৎ ধর্মের দিক থেকে মিল ছিল তাদের

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতন।এ থেকে পরিত্রাণ  পেতে আমাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, অনেকগুলো ধাপ পাড়ি দিতে হয়েছে। যেমনঃ

  • ·      ভাষা আন্দোলন -১৯৫২
  •        যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন -১৯৫৪
  • ·      সামরিক শাসন বাতিল -১৯৫৮
  • ·      ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৬-দফা কর্মসূচি
  • ·      ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান
  • ·      পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন (১৯৭০ এর নির্বাচন)
  • ·      উত্তাল মার্চ (মার্চের কলঙ্কিত অধ্যায়)
  • ·      ৭ মার্চের ভাষণ
  • ·      স্বাধীনতা ঘোষণা
  • ·      বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভূমিকা
  • ·      স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়
  • ·      পাকিস্তানীদের আত্নমসমর্পন
  • ·      বাংলাদেশ নামকরণ।

ভাষা আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদ

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল ঠিকই তবে এর ভাষা কি হবে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই । "১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা উর্দু করার প্রস্তাব করলে বাঙ্গালীদের নেতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এর বিরোধিতা করেন "৬

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস,বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯৪৭-১৯৭১,সংক্ষেপে বাংলাদেশের ইতিহাস,স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এসাইনমেন্ট,মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ১৭ তারিখে চৌধুরী খলিকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন।

তাদের এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার ভাষাবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ডঃ মোঃ এনামুল হকসহ বেশ ক'জন বুদ্ধিজীবী প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ জানান।

১৯৪৭ সালে কামরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত "গণআজাদীলীগ "মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের দাবি জানায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে সেপ্টেম্বর উক্ত সংগঠনের যুবকর্মী সম্মেলনে বাংলাকে শিক্ষাও আইন-আদালতের বহন করার প্রস্তাব করেন।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর এই সংগঠন " পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু" এ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে।

১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা এসে ঘোষণা করলেন উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা তার প্রতিবাদ করে বিক্ষোভ শুরু করে দেয়।

আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার এবং আরো অনেকে। তারপরেও সেই আন্দোলনকে থামানো যায়নি। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। 

 

যুক্তফ্রন্টঃ

পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনালগ্নেই শাসক গোষ্ঠী ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ বাংলা ভাষার উপর আক্রমন করে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় আঘাত হানে।

এ আঘাত প্রতিহত করতে গিয়ে বাঙালি জাতি মাতৃভাষার জন্যে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে সৃষ্টি করে এক রক্তাক্ত ইতিহাস।

মূলত পাকস্তান সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, অর্থনৈতিক শোষণ ও দু' অঞ্চলের মধ্যকার প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঙালি জাতির আবহমান ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপর আঘাত সর্বোপরি ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলায় মুসলিমলীগ সরকারের জনপ্রিয়তা শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনে এবং বাঙালি জাতীয়বোধের উন্মেষ ঘটায়।  পূর্ব বাংলার জনগণ এহেন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক এ নির্বাচনকে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। 

যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরিক দলগুলো ছিল মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী-মুসলিমলীগ,

এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টি

মওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বাধীন নেজামে ইসলাম পার্টি।

 

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের প্রথম সারির নেতা।

এ নির্বাচন বিভিন্ন দল (১৬ টি দল) অংশগ্রহণ করলেও ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের সাথে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় যুক্তফ্রন্টের। নির্বাচনের মুসলিম লীগের প্রতীক ছিল 'হারিকেন' এবং যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল 'নৌকা'।

যুক্তফ্রন্ট ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ২১ফেব্রুয়ারিকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেন এবং এটিকে ইস্তেহার হিসেবে জনগণের সামনে ঘোষণা করে।

১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৮-১২ মার্চ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পূর্ববাংলা আইন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের মোট আসন সংখ্যা ছিল ৩০৯ টি।

*সংরক্ষিত মুসলিম আসন ২৩৭ টিঃ

১.যুক্তফ্রন্ট ২১৫+০৮=২২৩

২.মুসলিম লীগ ০৯+০১=১০

৩.খেলাফতে রব্বানী পার্টি =০১

৪.নির্দলীয় সদস্য =০৩

 

*সংরক্ষিত অমুসলিম আসন ৭২ টিঃ

১.তফসিলি ফেডারেশন -২৭

২.কংগ্রেস দল -২৪

৩.যুক্তফ্রন্ট -১৩

৪.খ্রিস্টান সম্প্রদায় -০১

৫.বৌদ্ধ সম্প্রদায় -০২

৬.কমিউনিস্ট পার্টি -০৪

৭.নির্দলীয় সদস্য -০১

 ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ দফা কর্মসূচি

দেশের সামরিক শাসন, আবার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর এত রকমের বঞ্চনা, কাজেই বাঙালিরা সেটি খুব সহজে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। বাঙ্গালীদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগের তেজস্বী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন।

যা ছিলো বাঙালির মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা।

 ২৪ জানুয়ারী ২০২০ খ্রিস্টাব্দে যুগান্তর পত্রিকায় তোফায়েল আহমেদ একটি লেখা প্রকাশ করেনসেখানে তিনি বলেন,

·   বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা দেন তখন আমি ইকবাল হলের ভিপিইকবাল হলে বসেই ৬ দফার পক্ষে আমরা আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করিআমার কক্ষ নম্বর ছিল ৩১৩ দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন- সাঁকো দিলাম স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য

একে বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বা মুক্তির সনদ বলা হয়

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাঃ

 

কিন্তু ১৮ জানুয়ারি জেল গেটের বাইরে পা রাখার সাথে সাথেই তাঁকে পাকিস্তান আর্মি নেভী এবং এয়ারফোর্স এক্ট- এ গ্রেপ্তার করে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।

১৮ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের পর সরকারি প্রেসনোটে বলা হয় যে,

· "শেখ মুজিবসহ গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিলো এবং পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহযোগীরা ভারতের আগরতলায় গোপন বৈঠকে বসে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র করেছিল । "

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী করে মোট ৩৫ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তৈরি করা হয়।

১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি জনাব এম. এ  রহমানের নেতৃত্বে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। সংশ্লিষ্ট আইন মোতাবেক (অর্ডিন্যান্স নং ৫-১৯৬৮) এ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো সুযোগ ছিল না।

১৯৬৮ সালের ১৯ জন কুর্মিটোলা সেনানিবাসে কড়া প্রহরায় রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর ও অন্যদের মামলা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু কে ফাঁসি দেওয়াই ছিল মামলার উদ্দেশ্য।

 

৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান

পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন সংগঠিত হয়। ২৪ জানুয়ারি হল গণঅভ্যুত্থান দিবস। পাকিস্তান সামরিক শাসনের উৎখাতের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের এই দিনে সংগ্রামী জনতা শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন  ও সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে মিছিল বের করে।

মিছিলের শহীদ হন নবকুমার ইনস্টিটিউশনের  নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমান।

প্রাণ দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদ- যার নামে আইয়ুব গেটের  এর নাম করা হয়েছে আসাদ গেট।

পাকিস্তানের ২২-২৩ বছরের ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন।

এ আন্দোলন্র ফলে স্বৈরাচারী  আইয়ুব খানে আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুসহ সবাইকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

 

৭০- এর নির্বাচনঃ

 

উনিশ'শ সত্তর খ্রিস্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর। এই দিনটিতে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সে নির্বাচনের পর বিজয়ী শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে।এর জের ধরে শুরু হওয়া তীব্র রাজনৈতিক সংকট শেষ পর্যন্ত গড়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। যার পরিসমাপ্তি ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে।

১৯৭০ সালের ১২–১৩ নভেম্বর পূর্ব বাংলার দক্ষিণের উপকূলীয় এলাকায় ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সে সময় এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি এবং রিলিফ পাঠানোর বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। উপরন্তু, ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য বিদেশ থেকে রিলিফ সামগ্রী এলেও সেসব দুর্গত এলাকায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন দেরিতে। দেশবাসী ক্রুদ্ধ হয় কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু তাঁর দলের মানুষদের নিয়ে ত্রাণকাজে নিজেকে যুক্ত করেন। এই ঘটনায় প্রায় ১০ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এলাকায়। এরপর ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে 

 

উত্তাল মার্চ

 

জয় বাংলা

বীর বাঙালি অস্ত্রধর

বাংলাদেশ স্বাধীন কর।

বঙ্গবন্ধু ঢাকাসহ সারাদেশে পাঁচ দিনের জন্য হরতাল ও অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন।

বঙ্গবন্ধুর একটি কথায় সাড়া পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে গেল। কারফিউ জারি করে দমিয়ে রাখতে পারেনি।

২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হলো।

৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্র লীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের"আমার সোনার বাংলা "গানটি নির্বাচন করা হলো।

 


৭ মার্চের  ঐতিহাসিক ভাষন ও ফলাফল

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ঐতিহাসিক জনসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদাত্তকন্ঠে যে ঘোষণা প্রদান করে তা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক স্মরণীয় দলিল হিসেবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে খ্যাত হয়ে থাকবে।

বঙ্গবন্ধুর অগ্নিঝরা বক্তব্য,

"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। "

 

মার্চের ১৫  তারিখে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার ভান করতে থাকে, এরই মাঝে পাকিস্তান থেকে বিমান  দিয়ে ঢাকায় সৈন্য থাকে। যুদ্ধজাহাজে করে অস্ত্র এসে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করে, কিন্তু জনগণের বাধার কারণে সেই অস্ত্র তারা নামাতে পারছিল না।

১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বাঙালির সেনারা বিদ্রোহ করে বসে

২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস ;ক্যান্টনমেন্ট আর  গভর্নমেন্ট হাউজ ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের পতাকা খুঁজে পাওয়া গেল না।

অপারেশন সার্চলাইট

ইতিহাসের এক কালো কলঙ্কময় অধ্যায়।গনহত্যার জন্যেই ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ তারিখ টা বেছে নিয়েছিল কারণ সে এ দিনটিকে শুভ মনে করত। দু বছর আগে এই দিনে অর্থাৎ ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ সে ক্ষমতায় আসে।



২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণ হত্যার আদেশ দিয়ে সে সন্ধ্যাবেলা পশ্চিম পাকিস্তানের যাত্রা শুরু করে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনী কে বলেছিল,

"৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করো তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে।"৮

এই নিখুঁত পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই করা আছে সেই নীল নকশার নাম অপারেশন সার্চলাইট।

এই হত্যাযজ্ঞের কোন সাক্ষী যেন না থাকে এজন্যই সকল বিদেশি সাংবাদিকদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। তারপরেও সাইমন ড্রিং নামে একজন অত্যন্ত দুঃসাহসী সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা শহরের লুকিয়ে এই ভয়াবহতা হত্যার খবর ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে জানিয়ে ছিলেন।

২৫ শে মার্চের বিভীষিকার কোন শেষ নেই, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসে ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)  আর জগন্নাথ হলের  সব ছাত্রকে হত্যা করে।

হত্যার আগের দিন তাদের দিয়েই জগন্নাথ হলের সামনে একটি গর্ত করা হয়,  যেখানে তাদের মৃতদেহকে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যটি বুয়েটের প্রফেসর নুরুল তাঁর বাসা থেকে যে ভিডিও করতে পেরেছিল সেটি এখন ইন্টারনেটে মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধু ছাত্র নয় বরং শিক্ষক ও কর্মচারীদেরও হত্যা করা হয়। আশেপাশের বস্তিগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এবং মেশিনগান দিয়ে অসহায় মানুষকে হত্যা করা হয়।মন্দিরগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ২৫ শে মার্চ ঢাকা শহর ছিল নরকের মত সবদিকে আগুন আর আগুন।

অপারেশন সার্চলাইটের উদ্দেশ্য ছিল  বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা,

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল এসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।


স্বাধীন বাংলাদেশঃ

 

কমান্ডো বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যাবার আগে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। তাঁর ঘোষণাটি তৎকালীন ই.পি আর এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, তারপর সারাদেশে জানানো হয়।

২৬ মার্চের স্বাধীন বাংলার প্রথম বেতার কেন্দ্র চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে জনাব এম এ হান্নানসহ ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেন,

·   This may be my last message, from today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved’.

 

এর বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় এমন:

 ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ (সূত্র: অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।

জিয়া ঘোষণা পত্রটি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যেভাবে পাঠ করেছিলেন তা হলোঃ

· the Government of Sovereign state of Bangladesh, on behalf of our great leader, the supreme commander  Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman, we hereby proclaim the independence of Bangladesh and  the government headed by Sheikh Mujibur Rahman has already been formed. It is father proclaim that Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of the elected representatives of Seventy Five million people of Bangladesh, and the government headed by him is the only legitimate government of the people of independent Sovereign state of Bangladesh,which is legally and continuously formed, and is Worth of being recognised  by all the governments of the world.......May Allah help us Joy Bangla. "

 

 বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ফলে শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে পাকবাহিনী গণহত্যা লুণ্ঠন নারী নির্যাতনের বিভীষিকা সৃষ্টি করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে থাকে ছাত্র-যুবকদের দেখামাত্র গুলি করে হত্যা করতে থাকে কোন ১৯৭১খ্রিস্টাব্দের  ১০এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে প্রতিরোধ সংগ্রাম সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিণত হয় ।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ফলে শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম। প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে পাক-বাহিনী গণহত্যা, লুণ্ঠন,নারী-নির্যাতনের বিভীষিকা সৃষ্টি করে। গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিতে থাকে৷ ছাত্র-যুবকদের দেখা মাত্র তারা গুলি করে হত্যা করতে থাকে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আকাঙ্ক্ষা এই দেশের মানুষের বুকের মাঝে জাগিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে।

আর তখন  বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এই সংগ্রামের সম্য যে মানুষটি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন তাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি তাঁর পরিবারের সবাইকে তাঁদের নিজেদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে ৩০ মার্চ সীমান্ত পাড়ি দেন। তখন তাঁর সাথে অন্য কোনো নেতাই ছিলেন না, পরে তাঁদের সবার সাথে যোগাযোগ করে ১৯৭১ খ্রিস্টব্দের ১০ এপ্রিল 'মুজিবনগর সরকার' গঠন করেন। এখানে প্রধানমন্ত্রী হলেন, তাজউদ্দীন আহমেদ

রাষ্ট্রপতি হলেন, শেখ মুজিবুর রহমান

উপরাষ্ট্রপতি ও শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি হলেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে( বৈদ্যনাথতলা) বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে শপথ গ্রহণ করে তাদের অনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এ সরকার গঠিত হলে প্রতিরাধ সংগ্রাম সশস্ত্র ' মুক্তিযুদ্ধ ' বা ' স্বাধীনতা যুদ্ধে' পরিণত হয়।

তারপর মুজিবনগর সরকার 'মুক্তিবাহিনী ' গঠনে মনোনিবেশ করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন কর্নেল এম.এ.জি ওসমানী, চীফ অব  স্টাফ নিযুক্ত হন কর্নেল অব আব্দুর রব এবং ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন ক্যাপ্টেন এ.কে খন্দকার। মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (EBR) ও পূর্ব  পাকিস্তান রাইফেলসের (EPR)  নিয়মিত সৈনিকদের নিয়ে তিনটি বাহিনী গঠন করে।

এই তিনটি বাহিনী হলো মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে' জেড ফোর্স,  মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে 'কে ফোর্স' এবং মেজর কে.এম শফিউল্লার নেতৃত্বে 'এস ফোর্স'। মুক্তাঞ্চল এবং ভারতে চলে যাওয়া হাজার হাজার যুবককে প্রয়োজনীয় সামরিক ও গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়।

মুজিবনগর সরকার সমগ্র বাংলাদেশের যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে এবং একটি সেক্টরের দায়িত্ব প্রদান করে এক একজন সেক্টর কমান্ডারের হাতে৷ ১০ নং সেক্টর ছিল নৌ অঞ্চলের অধীনে। এটিতে কোনো সেক্টর কমান্ডার না থাকার কারণে এটি সরাসরি চীফ অব কমান্ডারের অধীনে ছিল।

নৌ-কমান্ডোরা অপারেশন জ্যাকপটের অধীনে একটি অবিশ্বাস্য দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ গ্রহণ করে ১৫ই আগস্টে চট্টগ্রামে  অনেকগুলো জাহাজ মাইন দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। ৯


মুক্তিযোদ্ধারা চূড়ান্ত জয়ের নেশায় মরিয়া হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমন চালাতে থাকে৷ স্থানীয় জনগণের সমর্থন না পাওয়ায় পাকিস্তানি-বাহিনী এ সময় নিরীহ জনগণের ওপর অত্যাচার শুরু করে। সমগ্র বাংলাদেশকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার নেশায় পাগল হয়ে ওঠে। ফলে প্রায় ১ কোটি মানুষ সহায় সম্বলহীন হয়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় গ্রহণ করে। লেখক আহমদ ছফাও সেখানে শরণার্থী ছিলেন। তিনি তাঁর  মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনা" অলাতচক্র" এতে শরণার্থীদের করুণ দুঃখের কথা লিপিবদ্ধ  করেছেনতিনিও শরনার্থীদের সংখ্যা ১ কোটিই বলেছেন

 

 

লক্ষ লক্ষ কিশোর-যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের ভেতরে এবং ঢাকা শহরে শুরু হয় গেরিলা অপারেশনস্বাধীন বাংলা বেতারের জাতীয় সংগীত, সংবাদ বুলেটিন এবং 'চরমপত্র' অনুষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে আরো উদ্দীপ্ত করে তোলেমুক্তি বাহিনীর পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ ওমানের প্রশিক্ষণে মুজিব বাহিনীর নামে একটি বাহিনী গঠিত হয়এ বাহিনীর সংগঠক ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনি আব্দুর রাজ্জাক সিরাজুল ইসলাম খান এবং তোফায়েল আহমেদ এছাড়াও দেশের অভ্যন্তরের কাদেরিয়া বাহিনী বাহিনী বাহিনী গড়ে ওঠেসময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকবাহিনীর সমর্থনে শান্তি কমিটি রাজাকার আলবদর আলশামস নামক বিশেষ বাহিনী গড়ে ওঠেজামায়াত নেতা মাওলানা এ.কে.এম ইউসুফ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের  মে মাসে খুলনায় সর্বপ্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করেনইসলামী ছাত্রসংঘের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে আলবদর বাহিনীপাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার যে নীলনকশা ও তালিকা তৈরি করেন তা বাস্তবায়ন করে আলবদর বাহিনীএর পাশাপাশি ছিল মুসলিম লীগ ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক দলের ছাত্র সংগঠনের দ্বারা 'আল-শামস' বাহিনীএ সংগঠনটি ও বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধনের তৎপর ছিলতবে দেশের বাইরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় প্রবাসীদের অনেক বাঙালি মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করেছেন তারা মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ সরকারের জন্য টাকা তুলেছেন পাকিস্তানের গণহত্যার কথা পৃথিবীতে জানিয়েছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনমত তৈরী করেছেনমুক্তিযুদ্ধের জন্য  আন্তর্জাতিক পর্যায়ে  একটি কন্সার্ট সারা পৃথিবীতে বিবেক নাড়া দেয়রবি শংকর এবং জর্জ হ্যারিসন সহ অসংখ্য শিল্পী এ কন্সার্ট দিয়েছিল   শুধু বাংলাদেশের এর মুক্তিযুদ্ধের আর্থিক সাহায্য করার জন্য আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ শরণার্থীদের কষ্ট নিয়ে সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড নামে একটি অসাধারণ কবিতা রচনা করেন

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার কথা পৃথিবীতে প্রচার হওয়ার পর পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই সমবেদনা বাংলাদেশের পক্ষে ছিল, তবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে কাজ করেছেএকাত্তরে যদিও ইসলামের নামে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মুসলমানকে হত্যা করা ছিল তারপরও পৃথিবীর প্রায় সকল মুসলিম দেশ ও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতা করেছেযদিও রাজনৈতিক কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানের পক্ষে ছিল কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলপাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণ হত্যার দৃশ্য দেখে সে সময়কার মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্চার কে ব্লাড ক্ষুব্দ হয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের টেলিগ্রামটা পাঠিয়েছেন সেটাইতো জগতের সবচেয়ে কঠিন ভাষায় লেখা চিঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়

স্বাধীনতা সংগ্রামের একেবারে শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের যুদ্ধজাহাজ বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়ে দিয়েছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নও নিউক্লিয়ার ক্ষমতাধারী যুদ্ধজাহাজ এই এলাকায় রওনা করে দিয়েছিল অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে উপলক্ষ করে বিশ্বের দুই পরাশক্তি নিউক্লিয়ার অস্ত্র নিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল

স্বাধীনতাযুদ্ধের একেবারে শেষ মুহূর্তে যখন বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ বাহিনীর যে একেবারে সুনিশ্চিত তখন সেই বিজয়ের মুহূর্তটিকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত করেছিলতবে আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে যে দেশটির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি সেই দেশ হচ্ছে ভারত এ দেশটির প্রায় এক কোটি শরণার্থীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়েছিল এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণার্থীদের সাহায্য করেছিলএই যুদ্ধে ভারতের প্রায় দেড় হাজার সৈনিক প্রাণ দিয়েছিলদেখে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের আত্মসমর্পণের দলিলে বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ নেতৃত্তের কাছে আত্মসমর্পণ করার কথাটি দেখে একজন পাকিস্তানের জন্য সেখান থেকে বাংলাদেশের নাম সংশোধনের প্রস্তাব করেছিল কিন্তু কেউ তার কথাকে গুরুত্ব দিলো না  (শিক্ষক,ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার,বুদ্ধিজীবী,লেখক,সাংবাদিক, বিজ্ঞানী)১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে হত্যা করা শুরু করে যেন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও আর সহজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পাড়ে

 

আত্মসমর্পণ বিজয়

মুক্তিযুদ্ধের ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্য আহ্বান করলোগভর্নর হাউসে বোমা ফেলার কারণে তখন গভর্নর মালেক আর তার মন্ত্রীরা পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বর্তমান শেরাটনে আশ্রয় নিয়েছেভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকার সেনাবাহিনীর সেখানে লেখা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আগে আমাদের কাছে আত্মসমর্পন করোঢাকার পরম পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তখন আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিলবিকেলবেলা রেসকোর্স ময়দানে হাজার হাজার মানুষের সামনে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে মাথা নিচু করে বিদায় নেয়ার দলিলে স্বাক্ষর করেঅবশেষে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পরে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টি হয় 

তথ্যসুত্রঃ

. প্রফেসর মোঃ মুজাম্মেল হক,পৌরনীতি সুশাসন;জুন-২০১৩; পৃ-৬৩

.প্রাগুক্ত ;পৃ৬৪

.প্রাগুক্ত, পৃ-৬৪

. প্রাগুক্ত, পৃ-৬৪

.মোহাম্মদ জাফর ইকবাল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস;পৃ-০১

.বাংলাদেশ বিশ্বপরিচয়, নবম-দশম শ্রেণি

.তোফায়েল আহমেদ যুগান্তর পত্রিকা, ২৪ জানুয়ারি, ২০২০

.মোহাম্মদ জাফর ইকবাল, পৃ-০৭

. মুক্তিযুদ্ধে নৌ অভিযান, মোঃখলিলুর রহমান, পৃঃ ৬৬)

 

সহায়ক গ্রন্থ, ব্লগ পত্রিকা

*ফকির ফারুক,ইসলামের ইতিহাস সংস্কৃতি

*বিবিসি

*প্রথম আলো

*বাংলাপিডিয়া

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url