সমাজ সংস্কারে নবাব ফয়জুন্নেসার অবদান
মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধাংশই নারী। বাংলাদেশে নাারী-পুরুষের সংখ্যা “পুরুষ : ৮.১০ কোটি ও মহিলা : ৮.০৭ কোটি”১
সমাজে নানা রকম কুসংস্কার,অনাচার,অপরাধ হয়ে থাকে। আর তখনই সমাজকে সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্যে প্রয়োজন হয় সমাজ-সংস্কারের। নারীদের বাদ দিয়ে অর্থাৎএই বিশাল অংশকে বাদ দিয়ে আদৌ কি উন্নয়ন সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব নয়। একটি সমাজ,রাষ্ট্র বা দেশকে সুন্দর ও উন্নত করতে হলে এই বিশাল জনশক্তিকে উপেক্ষা করার কোনো পথ নেই।
তাই কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর নারী কবিতায় বলেন, সাম্যের গান গাই-
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর অর্ধেক তার নারী।২
নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা নওয়াব। তিনি সমাজ সংস্কারের অংশ হিসেবে মেয়েদের শিক্ষার প্রতি জোর প্রচেষ্টা চালান। তিনি একই সাথে জমিদার, নারীশিক্ষার প্রবর্তক, সমাজসেবক ও কবি ৷ এই মহীয়সী নারী কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলাধীন পশ্চিমগাঁও গ্রামে এক জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবনকাল (১৮৩৪-১৯০৩)খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত । সে সময় জমিদার বংশের সন্তান হিসেবে বেশ আরাম-আয়েশের মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে ওঠেন। “মোঘল রাজত্বের উত্তরসূরি এই মহীয়সী নারীর দুই ভাই (এয়াকুব আলী চৌধুরী এবং ইউসুফ আলী চৌধুরী) আর দু’বোন (লতিফুন্নেসা চৌধুরানী এবং আমিরুন্নেসা চৌধুরানী) ছিলেন। ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ায় তার প্রচুর আগ্রহ দেখে তার বাবা তার জন্য একজন গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পালন করে তার জ্ঞানস্পৃহাকে আরো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তোলেন। গৃহশিক্ষকের সাহায্যে ফয়জুন্নেছা খুব দ্রুতই কয়েকটি ভাষার ওপর গভীর জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন। বাংলা, আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত এ চারটি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভসহ ফয়জুন্নেছার এ প্রতিভা স্ফুরণে তার শিক্ষক তাজউদ্দিনের অবদান অতুলনীয়। ফয়জুন্নেছা তার চিন্তা কাজ কর্মে ছিলেন সে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক। সেকালের সমাজব্যবস্থার সবরকম বাধা পেরিয়ে তিনি সম্পূর্ণ কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনে মনযোগ দিয়েছিলেন। তাই একজন নারী হয়েও সে সময়ে জমিদারির কঠোর দায়িত্ব তিনি সফলভাবে পালন করতে পেরেছেন। তিনি নির্ভীকভাবে শাসনকাজ পরিচালনা করেন।“ ৩
"""""ফয়জুন্নেসা
জমিদারি লাভের পূর্ব থেকেই সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড এবং দীন-দরিদ্রের কল্যাণে
আত্মনিয়োগ করেন।
“নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী ছিলেন একজন প্রজাহিতৈষী সুশাসক। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে বেড়ে উঠলেও তিনি ছিলেন বিদ্যানুরাগী। ছিলেন সমাজ সংস্কারক। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন সমাজে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি নারীশিক্ষা প্রচার ও নারীদের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে অথনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে উৎসাহিত করেছেন।সেই চিন্তা থেকে তিনি রোকেয়ার জন্মের আগে প্রতিষ্ঠা করেছেন ফয়জুন্নেছা স্কুলসহ দুটি বালিকা বিদ্যালয়।প্রতিষ্ঠা করেছেন হাসপাতাল, মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট, কালভার্ট। সবই করেছেন প্রজাদের কল্যাণে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠায়ও আর্থিক অবদান রেখেছেন এই পরোপকারী বাংলার নবাব।“৪
“ ১৮৭৩ সালে তিনি নারীশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এটি উপমহাদেশে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রাচীনতম স্কুলগুলির অন্যতম। কালক্রমে এটি একটি কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং এর নাম হয় নবাব ফয়জুন্নেসা কলেজ। জমিদার হওয়ার পর তাঁর সেবার হাত আরও প্রসারিত হয়। ১৮৯৩ সালে পর্দানশীন, বিশেষত দরিদ্র মহিলাদের চিকিৎসার জন্য তিনি নিজ গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তিনি ‘ফয়জুন্নেসা জেনানা হাসপাতাল’ নামে একটি চিকিৎসালয়ও স্থাপন করেন। এছাড়া মসজিদ, মাদ্রাসা ইত্যাদি নির্মাণেও তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণ, দিঘি-পুষ্করিণী খনন প্রভৃতি জনহিতকর কাজে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।১৮৯৪ সালে হজ্জ পালন করতে গিয়ে ফয়জুন্নেসা মক্কায় একটি মাদ্রাসা ও একটি মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর আগে তিনি জমিদারির এক বিশাল অংশ ওয়াকফ করে যান, যা থেকে এলাকার দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্ররা আজও অর্থসাহায্য পেয়ে থাকে।৫
“মহারানী ভিক্টোরিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ফয়জুন্নেছাকে বেগম উপাধিতে ভূষিত করেন।কিন্তু ফয়জুন্নেছা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর “১৮৮৯ সালে তাঁর নির্দেশক্রমে ফয়জুন্নেছাকে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘নওয়াব’ উপাধি দেয়া হয়।“৬
তথ্যসূত্রঃ
১.bangladesh.gov.bd
২.
নারী-সাম্যবাদী-কাজী
নজরুল ইসলাম
৩.Bhorerkagoj
৪.Jugantor
৫.Banglapedia
৬.Bhorerkagoj