প্রেমিকা থেকে ধর্ষিতা !

প্রেমিকা থেকে ধর্ষিতা !

ইদানীং প্রায় প্রতি দিনই দৈনিক পত্রিকার কোনো না কোনো পাতায় ধর্ষণের খবর আসে। দেশে ধর্ষণের পরিমাণ বৃদ্ধি উদ্বেগজনক। ধর্ষণের পরিসংখ্যানটা দেখলেও যে কোনো ব্যক্তির চক্ষু চড়কগাছ হবার উপক্রম হবে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য অনুযায়ী গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে মোট ১৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর আগে ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল মোট ৭৩২ জন। এই সংখ্যাটা শুধু প্রকাশিত ঘটনাগুলোর পরিসংখ্যান। আসল সংখ্যা হয়তো আরও বেশি। কারণ আমরা জানি বাংলাদেশে এখনও অনেক নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা লোকলজ্জা বা সম্মানহানির ভয়ে প্রকাশ পায় না।

পত্রিকার পাতায় আসা খবরের শিরোনামগুলোও অত্যন্ত ভয়াবহ, গা শিউরে ওঠার মতো। পাঠকদের অবগতির জন্য কিছু শিরোনাম তুলে ধরছি। 

প্রেমিকা নাকি ধর্ষিতা


★ অমুক জায়গায় কিশোরীকে গণধর্ষণ।
★ বিয়ের প্রলোভণ দেখিয়ে কিশোরীকে ধর্ষণ।
★ কিশোরীকে গণধর্ষণের পর হত্যা।  
★ প্রেমিকাকে ধর্ষণের পর ভিডিও ভাইরাল।
★প্রেমিকাকে রুমে নিয়ে গিয়ে বন্ধুরা মিলে গণধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে টাকা দাবি।
এরকম আরো অনেক গা ছমছম করা শিরোনামে খবরগুলো প্রকাশিত হয়।



তবে এই ধর্ষণের ঘটনাগুলোর একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যা সংঘটিত হয় প্রেমঘটিত বিষয়গুলো থেকে।

বর্তমান সমাজে প্রেমের সম্পর্ক এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে, সেটাকে আর কোনো সম্পর্কের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এখন প্রেম মানেই ডেটিং, হাগিং, কিসিং, লিভ টুগেদার, রুমডেট ইত্যাদি। একটা সময় ছিল যখন মানুষ প্রেম শব্দটা তেমন ব্যবহারই করতো না। আজ থেকে মাত্র কয়েক বছর আগেও এমনটা ছিল। কোনো ছেলের সাথে কোনো মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক থাকলে সেটাকে শুধু "সম্পর্ক" নামেই সম্বোধন করা হতো। বলা হতো "অমুকের সাথে অমুকের সম্পর্ক আছে"। প্রেম শব্দটা খুব কমই ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এখন প্রেমের সাথে সম্পর্ক শব্দটাকে যুক্ত করলে সম্পর্ক শব্দটাকেই বরং অপমান করা হবে। আজকাল অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, আজকে প্রেম হলে দু চারদিন একা একা দেখা করা, কোথাও একা একা ঘুরতে যাওয়া, হাগিং, কিসিং এবং একটা পর্যায়ে এসে দেখা যায় যে, প্রেমের বয়স ছয় মাস হতে না হতেই লিভ টুগেদার, রুমডেট অর্থাৎ শারীরিক সম্পর্ক করা হয়ে যায়। সোজা বাংলায় যেটাকে বলা হয় যৌনাচার। কোনো সন্দেহ নেই যে, এক্ষেত্রে ছেলেরাই বেশি দোষী। বলা হয়ে থাকে, ছেলেরা হচ্ছে শকুনের চেয়েও ভয়ঙ্কর। যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য যেকোনো ফাঁদ পাততে তারা ওস্তাদ।  

 আর প্রযুক্তি উন্নত হবার কারণে এক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ে কারোরই অসম্মতি থাকে না। যদি প্রথম প্রথম মেয়ে রাজি না হয় তাহলে ছেলে তাকে বিভিন্নভাবে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। এভাবে একটা পর্যায়ে মেয়েটা হয়তো অনিচ্ছা সত্বেও ফাঁদে পা দেয়।

গত কয়েকদিন আগে একটা জাতীয় দৈনিক পত্রিকার একটা লেখা পড়লাম যেখানে বলা হয়েছে, ১৪ ফেব্রুয়ারী অর্থাৎ ভালোবাসা দিবসে এবং থার্টি ফার্স্ট নাইট নামক এসব দিবসে রাজধানীর হোটেলগুলোতে রুমপ্রতি ভাড়া বাড়িয়ে প্রায় দশ হাজার টাকা করা হয় মাত্র একটা রাতের জন্য। কোনো কোনো হোটেলে এর চেয়েও বেশি। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এত ব্যয়বহুল হওয়া সত্বেও ১৪ ফেব্রুয়ারী বা থার্টি ফার্স্ট নামক এই দিনে বা রাতে হোটেলগুলোর একটা রুমও খালি থাকে না। এবং হোটেল মালিকদের ভাষ্যমতে, হোটেলগুলোতে অবিবাহিত ছেলে মেয়েরাই বেশি যায়।

তারা হয়তো ভাবে এটাতে কোনো সমস্যা নেই। প্রযুক্তি তাদেরকে দিয়েছে "কনডম" নামক এক আশ্চর্য জিনিস যা ব্যবহার করলে এসব লিভ টুগেদার বা রুমডেট কোনো ঝামেলার বিষয় নয়। কারণ এতে তাদের মাধ্যমে দৈবক্রমে উৎপাদিত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পৃথিবীটা সেই "কনডম" নামক আজব বস্তুটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এছাড়া এসব ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য আধুনিক বিজ্ঞান ও চিকিৎসাব্যবস্থা আমাদেরকে আরও অনেক এগিয়ে দিয়েছে।

এ তো গেল এক দিকের কথা। অন্যদিকে তাদের এই তথাকথিত লিভ টুগেদার বা রুমডেটকে স্মরণীয় করে রাখতে ছেলেটা আবার মেয়েটাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে যেন সেই দৃশ্যগুলোর ভিডিও ধারণ করতে মেয়েটি রাজি হয়। অনেকে আবার এই কাজটা গোপনেও করে থাকে। তখনও সেই মেয়ের অর্থাৎ বাংলার সেই দামাল ছেলের প্রাণপ্রিয়া প্রেমিকার টনক নড়ে না। তারপরও এসব চলতে থাকে। একটা সময় গিয়ে যখন তাদের মাঝে ছোটখাটো কোনো ঝগড়া হয় বা মেয়ে আবার রুমডেট করতে রাজি না হয় তখন সেই ভিডিওটিই শক্তিশালি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ফলে মেয়ে আবার দুর্বলতাবশত রাজি হয়ে যায়। কারণ তার গুণধর প্রেমিক বলে দিয়েছে, যদি রাজি না হও তবে ভিডিও ভাইরাল করবো। এভাবে একটা সময় যখন ব্ল্যাকমেইল করে টাকা দাবি করে বা অন্য কোনো বড় কিছু দাবি করে তখন মেয়ে আর সামাল দিতে না পেরে তার সেই তথাকথিত লিভ টুগেদার বা রুমডেটকে ধর্ষণ বলেই চালিয়ে দেয়। পাঠকগণ হয়তো ভাবতে পারেন, সম্মানের চেয়েও বড় আর কিই বা দাবি করতে পারে মেয়েটির কাছে?

তাদের জন্য বলছি, সম্মানটা আসলে ওই মেয়ের কাছে তেমন দামি কোনো বিষয়ই না। যদি তাই হতো তাহলে এতোদিন সেই সম্মানকে এভাবে বিলিয়ে দিয়ে আসতো না।

এরপর কি হয়? এরপর যা হবার তাই হয়। মেয়েটা ধর্ষিতার তকমা মাথায় নিয়ে থানা পুলিশ থেকে হাসপাতাল, সেখান থেকে আদালত, সেখান থেকে আবার রাস্তায় দাড়িয়ে ধর্ষকের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করে। অর্থাৎ তার সম্মান যেটাকে নিয়ে আজকে তার গর্ব করার কথা ছিল তা রুমডেটে ব্যবহৃত সেই কনডমের সাথেই ডাস্টবিনে চলে গেছে। আজ তার নামটিও ধর্ষণের শিকার সেই ১৪১৩ জন নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছে হয়তো৷ আজ সে একজন ধর্ষিতা।

আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন স্বাধীনচেতা মানুষ। আমি নিজের পাশাপাশি পৃথিবীর সকল মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। হোক সে নারী কিংবা পুরুষ কিন্তু অন্য কোনো লিঙ্গের। কিন্তু যেই স্বাধীনতার অপর নাম লিভ টুগেদার, যেই স্বাধীনতার অপর নাম রুমডেট, যেই স্বাধীনতার অপর নাম অবাধ যৌনতা আমি সেই স্বাধীনতার বিপক্ষে। ১৯৭১ সালে বাংলার প্রায় দুই লক্ষ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। যাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা আজ এই স্বাধীন সোনার বাংলা পেয়েছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দিও"। কিন্তু আজকে যারা বিলাসিতার নামে তথাকথিত লিভ টুগেদার করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হবার পর নিজেকে ধর্ষিতা বলে দাবি করেন, আমার জানতে ইচ্ছে করে তাদের বাবা যদি তাদের এই কর্মকাণ্ড জানতে পারেন তাহলে তিনি কি বলতে রাজি হবেন যে, " ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দিও "?

হয়তো তিনি বলবেন। কারণ, তিনি একজন বাবা। কোনো নষ্ট মানসিকতার পুরুষ মানুষ নন, নন তথাকথিত কোনো প্রেমিক পুরুষ।

লেখকঃ সৈকত ইসলাম

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url