ফোকলোর চর্চায় আশুতোষ ভট্টাচার্য Ashutush Bhattacharya in Folklore studies.
ফোকলোর চর্চায় আশুতোষ ভট্টাচার্য
জীবনকাল(১৯০৯-১৯৮৪)
ফোকলোর এর বাংলা প্রতিশব্দ নিয়ে অনেক ফোকলোরবিদ ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছে। কেউ বলেছে লোকসাহিত্য, কেউ বলেছে লোকজ্ঞান,লোকযান,লোকসংস্কৃতি ইত্যাদি।কোনোটিই ১০০ভাগ ফোকলোর এর অর্থ বহন করেনা,তাই Folklore এর প্রতিশব্দ অন্যকিছু না নিয়ে ফোকলোরই রেখেছেন ড.মযহারুল ইসলাম। ড.আশরাফ সিদ্দিকী “কিশোরগঞ্জের লোককাহিনী “এর ভূমিকায় বলেন” যা কিছু লোকঐতিহ্যের মাধ্যমে চলে এসেছে কাহিনী,সংগীত, হস্তশিল্প, চারুশিল্প,কারুশিল্প ইত্যাদি সবকিছুই লোকসংস্কৃতি বা ফোকলোর।“ Archer Taylor বলেন,” Folklore is the material that is handed on by tradition either by the word of mouth or by custom and practice. It maybe folksongs,folktales,riddles,proverbs or other material preserved in words.”
এখন এখন আসি ফোকলোর চর্চা সম্পর্কে।ফোকলোর আজ একটি বিশ্ব স্বীকৃত বিদ্যাশাখা। ফোকলোরচর্চা শুরু হয়েছিলো মিশনারীদের হাতে।তারা আমাদের দেশ শাসনের সুবিধার্থে দেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে।তাদের মধ্যে অনেকে বাংলার লোকজীবন ও লোকসাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লোকসাহিত্য সংগ্রহ শুরু করেন।১৭৮৪ সালে স্যার উইলিয়াম জোন্স এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন যার সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে লোকসংস্কৃতির। ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশ ফোকলোরবিদ উইলিয়াম জন থমস্ Folklore শব্দটি উদ্ভাবন করার পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এর পঠনপাঠন শুরু হয় নতুন উদ্যমে। ইউরোপীয় পন্ডিতের দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে পরবর্তীতে বাঙালিরা ফোকলোরচর্চায় এগিয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন,মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন প্রমুখ ব্যক্তিরা লুপ্তপ্রায় লোকসাহিত্যের অমূল্য ভান্ডার আমাদের সামনে নিয়্র আসেন।তাদের মধ্যে আশুতোষ ভট্টাচার্য ছিলেন অন্যতম। বাংলাদেশের ফোকলোরের উপাদান সংগ্রহ ও গবেষণায় ড.আশুতোষ ভট্টাচার্য লোকসাহিত্যের বিচিত্র ধারা সম্পর্কে যে নান্দনিক বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন সেকারণে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ফোকলোর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন
জন্ম পরিচয়ঃ ১৯০৯ সালের ১৭ই জানুয়ারি, মাতুলালয় ময়মনসিংহের।তার পৈত্রিকনিবাস কিশোরগঞ্জের বকজোড়াকান্দি গ্রাম।তার পিতার নাম মুরারিমোহন ভট্টাচার্য এবং মাতা কুমুদিনী দেবী “
শিক্ষাঃ আজিমুদ্দিন মুন্সি উঃবিঃ( বাড়িতে প্রাথমিক পাঠ সম্পন্ন)
ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজ ( ঢাকা কলে) থেকে আই .এ পাশ করেন-১৯২৮ সালে।
সংস্কৃত পন্ডিত সুশীলকুুুমার দে এর তত্ত্বাবধায়নে গবেষণা শুুরু করেন, এম.এ পাশ করার পর। তার গবেষণার বিষয় ছিলঃ Latter history of chaitanya Movement. তারপর সুশীল কুমার দে কলকাতায় স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ায় তিনি নতুন করে গবেষণা শুরু করেন "বাংলা মঙ্গলকাব্য" বিষয়ে। তিনি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য ১৯৩৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে় কাগজপত্র জমা দেন । অজ্ঞাত কারণে ১৯৫৫ সালে তিনি লোকসাহিত্য বিষয়ে পিএইচডি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিষয়ক এটিই প্রথম পিএইচডি। ১৯৩৭থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পুরো একদশক আশুতোষ ভট্টাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন । ভারতের জাদুঘরে "Anthropological survey of India" প্রকল্পে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন।ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ অনুসন্ধান ছিল এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য । আশুতোষ ভট্টাচার্যের জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ এক ফোকলোর গবেষক । লোকসাহিত্যের প্রতিটি বিষয়ে তাঁর ছিল উৎসুক আগ্রহ নিবিড় অনুসন্ধান ও ভালবাসা। ফোকলোর এর প্রতি এই আবাল্য ভালবাসা তিনি লিখিত আকারে প্রকাশ করেন বিভিন্ন প্রবন্ধ ও রচনার মাধ্যমে । তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তখন তার প্রথম গবেষণাগ্রন্থ "বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস" প্রকাশিত হয। এ গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন ,"মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস রচনায় লেখক শ্রীযুক্ত আশুতোষ ভট্টাচার্য যে অসামান্য পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তা বিশেষ শ্রদ্ধার যোগ্য দুর্গম ও বহু বিস্তৃত ক্ষেত্র থেকে তিনি প্রভূত তথ্য সংগ্রহ এবং সতর্কতার সঙ্গে প্রমাণ বিশ্লেষণ করে তার ঐতিহাসিকতা নির্ণয় করেছেন। এই মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যেই বাংলা কাব্যভাষার প্রথম উপলব্ধির অভিব্যক্তি দেখা দিয়েছে। বাংলা সাহিত্যের পরিণতি আলোচনা কার্যে এই বইখানি বিশেষ সহায়তা করতে পারবে, এজন্য লেখক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সন্ধানকারীদের কৃতজ্ঞভাজন।
প্রবাদ সংগ্রহে অবদান:
সুশীল কুমার দে যখন বাংলা প্রবাদ নিয়ে গবেষণারত তখন তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকগুলো প্রবাদ সংগ্রহ করেন। তার অনেকগুলো প্রবাদ সুশীল কুমার দে এর বাংলা প্রবাদ ছড়া ও চলতি কথা (১৯৫৩) সংযুক্ত আছে।
বিভিন্ন জনজাতির উপর প্রবন্ধ:
ভেরিয়ান এলুইনের গবেষণা সহকারী থাকাকালে আশুতোষ ভট্টাচার্য নতুন করে আদিবাসী সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন । এলুইন এর উৎসাহে ও অনুপ্রেরণায় ভারতের বিভিন্ন জনজাতির উপর নিবিড় গবেষণা করতে থাকেন। বোন্ডা আদিবাসীদের নতুন ধান উঠানোর উৎসব নিয়ে Mombay Anthropological journal এ Bonda rites of new Rice এবং অন্যান্য জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ:
★সুন্দরবনের বাঘ কে নিয়েঃ The Tiger Cult and It's literature of lower Bengal
★শীতলা মা কে নিয়ে: cult of the smallpox goddess in West Bengal
★ ধর্ম পূজার ইতিহাস: Dharma Worship in West Bengal.
ফোকলোর সংক্রান্ত কিছু গ্রন্থঃ
★বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস ১৯৩৮
★ছয় খন্ডের বাংলা লোকসাহিত্য ১৯৫৪-৭২
★বাংলার লোকশ্রুতি ১৯৬০
★৪ খন্ডের বঙ্গীয় লোকসংগীত রত্নাকর ১৯৬৬-১৯৬৭
★পাঁচ খণ্ডের বাংলা লোকসংগীত ১৯৬২-১৯৬৬
★দুই খণ্ডের বাংলা লোকনৃত্য ১৯৭৬-১৯৮২
★বাংলা লোকসংস্কৃতি ১৯৮২
★Folklore of Bengal ১৯৭৮
★সম্পাদিত গ্রন্থ বাইশ কবির মনসামঙ্গল ১৯৫৪
★গোপীচন্দ্রের গান ১৯৫৯
আশুতোষ ভট্টাচার্য লোকনৃত্য "ছৌ" সবার মাঝে ছড়িয়ে দেন। ছৌ নাচের চারটি গ্রন্থ,
1.The Ramayana in Indian chau dance 1971
2.Chau dance of purulia 1972
3.Chau dance of purulia in Europe 1972
4.Chau masked dance of west bengal in America 1975
তার বাংলা লোকসাহিত্য গ্রন্থে স্থান প্রাপ্ত বিষয় ও প্রকাশকাল
খন্ড প্রকাশকাল বিষয়
১ম ১৯৫৪
২য় ১৯৬৩ ছড়া
৩য় ১৯৬৪ লোকসংগীত
৪র্থ ১৯৬৬ লোককথা
৫ম ১৯৬৯ ধাঁধা
৬ষ্ঠ ১৯৭২ প্রবাদ
✅বাংলা লোকসংগীত: গ্রন্থটি ৫ খন্ডের
✅বঙ্গীয় লোকসংগীত রত্নাকর ৪ খন্ডের।
ভারত তত্ত্ববিদ ভেরিয়ান এলুইনকে উৎসর্গকৃতগ্রন্থের অধ্যায় গুলিতে আঞ্চলিক সংগীত , ঘটনামূলক সংগীত, বিবিত সংগীত শিরোনামে বিভক্ত ছিল। লোক সঙ্গীতের ভাষা শ্রেণীকরণ নিয়ে তিনি অনেক আলোচনা করেছেন ।বাংলা লোকসংগীত জগৎ নিয়ে তার মত এত বিস্তারিত আলোচনা কেউ করেনি। বাংলা লোকসংগীত সবার মাঝে পৌঁছানোর কৃতিত্ব আশুতোষ ভট্টাচার্যেরই ।
লোকনৃত্য বিষয়ক গ্রন্থ
লোকনৃত্য বিষয়ক প্রথম লেখালেখি প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে বাংলার লোকসাহিত্য গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে ।শিরোনাম ছিল লোকসাহিত্যও বাংলার লোকনৃত্য নামে দুইটা পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেছেন ।
লোক কাহিনী
এ বিষয়় নিয়ে অনেকে কাজ করেছেন ।কিন্তু আশুতোষ ভট্টাচার্য সংগৃহীত লোককাহিনী বিচারে আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ করেন।
ধাঁধা
ছড়া, প্রবাদ ,লোক উপাদান নিয়ে যতটা আলোচনা হয়েছে ,ধাঁধা নিয়ে তেমটি হয়নি।আশুতোষ ভট্টাচার্য প্রথম ধাঁধার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ।তাঁর সম্পাদিত লোকশ্রুতি ১৯৬৮ পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যাটি তিনি পুরোটাই ধাঁধা দিয়ে সাজিয়েছেন । পত্রিকায় প্রকাশিত ৬ টি প্রবন্ধই ছিল ধাঁধাবিষয়ক ।
ক্ষেত্র সমীক্ষায় অবদানঃ
আশুতোষ ভট্টাচার্যই প্রথম ক্ষেত্রসমীক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে সরাসরি উপাদান সংগ্রহ করার কার্য পদ্ধতি তিনি শুরু করেন ১৯৬২ সালে।১৯৬২-৭১ সাল পর্যন্ত তিনি এই কাজ অব্যাহত রাখেন।
আশুতোষ ভট্টাচার্য , সমগ্রজীবন অতিবাহিত করেছেন ফোকলোর গবেষণা এবং এর পঠন-পাঠনে। তিনি চেয়েছিলেন ফোকলোরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে । তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন ফোকলোরের প্রায় শাখায় তার অবদান অনন্য। তাই আমরা বলতে পারি আশুতোষ ভট্টাচার্য ফোকলোরের পথিকৃৎ। ফোকলোরে তাঁর অবদান অনন্য।
আরও পড়ুন>>>
ভাষা আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদ
ছয় দফা আন্দোলন
স্বাধীনতা কি?
ফোকলোর কাকে বলে?
সমাজ সংস্কারে রোকেয়ার সাহিত্য
সমাজ সংস্কারে নবাব ফয়জুন্নেছার অবদান (প্রথম মহিলা নবাব)
প্রবাদ
চন্দ্রমুখী মৎস্যকন্যা(রোমান্টিক গল্প)
ভিন্ন কিছু পড়ুন
Book review Three am( থ্রি এ এম)
বুক রিভিউ (তোমাকে ভালোবাসি হে নবী)