জীবনের উত্থান-পতন
জীবনের প্রথম লম্বা ভ্রমণ ছিলো বাড়ি থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া। সেই ছোট্টোবেলায় প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় একটা ট্রেন ভ্রমনের গল্প পড়েছিলাম৷ গল্পটা ছিলো বাংলা বইয়ের। মেয়েটির নাম ছিলো অর্পা। অর্পা ছোট্ট একটা মেয়ে । সে ট্রেন দিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলো।যাওয়ার সময়ে সে খুব ভালোভাবে আশেপাশের রাস্তা, মাঠ, নদীনালা দেখতে ছিলো। অর্থাৎ সে খুব ভালোভাবে প্রকৃতির অপারসৌন্দর্য উপভোগ করতেছিলো। চট্টগ্রাম পৌছানোর সময় বড় বড় পাহাড় দেখছিলো। চট্টগ্রামের সুন্দর্য এত ভালো করে বর্ণনা করা হয়েছিলো যে পড়ার সময় মনে হয়েছে আমি নিজেই সেই ভ্রমণ টি করছিলাম। সেখান থেকে মনে মনে একটা ইচ্ছা জাগে আমি চট্টগ্রাম যাবো। কিন্তু যাওয়ার সুজোগ হয়ে উঠেনি । এইতো কয়েক মাস হলো এইচ.এস.সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে আমার৷ দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। ঢাকার বাইরে ফর্ম উঠাবো নাকি তা নিয়ে চিন্ততিত ছিলাম৷ আমার বড় ভাইয়া বলেছিলো ফর্ম উঠানোর জন্য। আমার বড় ভাইয়া এমন লোক যে আমাকে পড়ানোর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিতে চায়।ভাইয়ার কাছে কিছু চেয়েছি অথচ পাইনি এরকম কোনো ঘটনা আমার জীবনে এখন পর্যন্ত ঘটেনি৷ বিশেষ করে পড়াশোনার ব্যাপারে তো না ই... এক খাতা কেনার টাকা চাইলে ৫ খাতা কেনার টাকা দিয়ে দেন। অন্যান্যগুলো বাদই দিলাম, অন্য ভাইয়ারাও তেমনি আমাকে পড়ানোর জন্য অনেক কিছু করেছে এবং করছে। এখন লিখতে গেলে শেষ হবে না । ভাইয়া আমাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময় শুধু তাঁর মুখই ভেসে উঠতো আমার চোখের সামনে। যখন পরীক্ষা খারাপ হতো আমার নিজের কাছে নিজেকে এত ছোট মনে হতো যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।।। নিজে চান্স পাবো না এই ভেবে কষ্ট হতো না৷ কষ্ট হতো যখন ভাবতাম যে ভাইয়ার চাওয়াটা মনে হয় পুরণ করতে পারলাম না। সেই ভাইয়ার ইচ্ছাতেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম উঠালাম। তখন আমার সেই ছোট্টবেলার অর্পার ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যাওয়ার গল্পটা মনে পরে যায়। ভাবলাম হয়তো ছোটবেলার চট্টগ্রাম যাওয়ার সেই ইচ্ছাটা পুরণ হতে যাচ্ছে । আমি এবং আমার এক বন্ধু এক সাথেই ফর্ম উঠালাম। আর মাত্র ৩ দিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা । বন্ধুর কাছে টাকা পাঠিয়ে দিলাম টিকেট কাটার জন্যে। সে বাসের টিকেট কাটলো পরীক্ষার ২ দিন আগে ৷ বাড়ি থেকে বিকেলে বের হই নরসিংদী তে যাবো বলে । কারণ বাস নরসিংদী থেকেই ছাড়বে । নরসিংদী তে পৌঁছে ভাইয়ার সাথে দেখা করলাম৷ পরে মামার বাসায় গেলাম, রাতের খাবার খেয়ে বের হলাম৷ নরসিংদী রেলস্টেশনে বন্ধু ও তাঁর পরিচিত আরও ২জন একত্রিত হয়ে গেলাম বাস কাউন্টারে । অবশেষে আমরা বাসে উঠলাম। বাস ছাড়লো রাত ৯ টার পরে। আমি জানালার পাশের সীটে বসলাম। বাসে ঘুমালাম না ভ্রমণের মজা মিস হয়ে যাবে বলে। তাছাড়া ভাইয়াও মানা করেছিলো গাড়িতে ঘুমানোর জন্যে । কিছুক্ষণ ধরে জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি৷ আজ অনেক জোৎস্না আছে। চাঁদ টাও খুব ঝলমল করছে। খুব দ্রুত গাছপালা গুলো দৌঁড়ে আমাদের পিছনে চলে যাচ্ছে । সেই সাথে চাঁদ টা শুধু আমাদের সাথে আমাদের সমান গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। খুবই ভালো লাগছিলো। একটু পরপর ভাইয়া ফোন দিচ্ছিলো ঠিক আছি কিনা। গাড়ি কতটুকু পৌছালো ইত্যাদি জানার জন্যে । যতটুকু বুঝলাম ভাইয়াও রাতে ঘুমাইনি। বাড়ি থেকে আরেক ভাইয়াও ফোন দিচ্ছিলো৷ মা বাবা এবং আমার হাফেজ ভাই নাকি সারারাত নফল নামাজই পড়েছে যেনো আমি ঠিকমতো পৌঁছাই। কারণ এর আগে কখনো একা দুরে যাইনি। পরের দিন সকালে ক্যাম্পাস পৌছালাম। সেখানে গিয়ে শাহজালাল হলে থাকলাম। ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখলাম। খুবই ভালো লাগছিলো। ২ দিকে পাহাড় মধ্য দিয়ে রাস্তা । পাহাড়ের উপর বিভিন্ন ভবন। পাহাড়ের নিচেও অনেক ভবন। পাহাড়ের উপর অনেক গাছপালা। যেনো প্রকৃতির সব সবুজ ঢেলে দিয়েছে সেখানে। যাই হোক পরের দিন পরীক্ষা দিলাম। আমার সেন্টার পরে ক্যাম্পাসেই "ল্যাবরেটরি স্কুলে"। এখন যাই আসল ঘটনায়
পরীক্ষা দিয়ে বিকেলেই বের হয়ে যাই বাড়িতে আসবো বলে। আমরা ২ বন্ধু শাটল ট্রেন দিয়ে শহরে আসলাম। তারপর বাসের টিকেট কাটলাম। বাস ছাড়ার সময় এখনো বেশ দেড়ি । প্রায় ২ ঘন্টা। আমরা হোটেল থেকে খাওয়া দাওয়া করে আবার বাসের টিকিট কাউন্টারের কাছে আসলাম। সেখানে ছোট একটা চায়ের দোকান আছে। একটা বৃদ্ধ লোক চা বানাচ্ছে। কয়েকজন ছেলে দোকানে বসে চা খাচ্ছে। আমরাও চা খেতে গেলাম। বললাম ২ টা আদা চা দেওয়ার জন্যে।দোকানে বসে থাকা সেই ছেলেদের মধ্যে একজন বললো কোথায় যাবে?
বললাম নরসিংদী।
ঢাকা নরসিংদী?????
হ্যাঁ ।
এখানে এসেছিলা কেনো???
বললাম, ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি পরীক্ষা দিতে।
:::::বাহ, খুবই ভালো, আমিও চবিতেই ইংরেজি তে অনার্স করেছি।
আমি: বাহ শুনে খুবই ভালো লাগলো।
লোকটি বললো, আমি ঢাকা থেকেই কলেজ পর্যন্ত পড়েছি। তারপর চবি তে পড়েছি। আমার বাড়ি এখানেই, শুনে ভালো লাগলো। এর মধ্যে আমাদের জন্য দোকানের সেই বৃদ্ধ লোকটি চা বানিয়ে দিলেন।
তখন সেই ছেলেটি আমাদের বললো,,, এই বৃদ্ধলোকটিকে দেখো। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী ডিপার্টমেন্ট এর ফার্স্ট বয় ছিলো। এটা শুনে তো আমরা ২ জন অবাক হয়ে গেলাম। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে তিনি এখানে চা বিক্রি করেন কেনো?? তার এই অবস্থা কেনো? ছেলেটি বললো একটা একসিডেন্ট এর জন্যে আজ তার এই অবস্থা। চা পান করতে ছিলাম। কিন্তু মনে শুধু লোকটির জীবনের ঘটনা জানার আগ্রহ জাগছিলো। একপর্যায়ে আমি এবং আমার বন্ধু লোকটির কাছে গেলাম। চায়ের কাপ দিয়ে, বললাম আচ্ছা আংকেল আপনি নাকি ঢাবি তে পড়েছিলেন ?
আংকেলঃ হুম...
তাহলে আজ আপনার এই অবস্থা কেনো???
আংকেল::: সে এক দু:খের কাহিনি ।
আংকেল আমরা একটু শুনতে চাই আসলে আপনার জীবনে কি ঘটেছিলো...
আংকেল:: আমি ১৯৮৩ (৮৩ বলেছিলেন নাকি এখন ভুলে গিয়েছি) এর দিকে আমি ঢাবি তে ইংরেজী তে অনার্স করি৷ আমি ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট ছিলাম। তখন টিউশনি করে হাজার হাজার টাকা পেতাম। অনার্স শেষে আমি আমেরিকা চলে যাই। অনেক বছর থাকি সেখানে । তখন আমি লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক ছিলাম। আমি ছিলাম আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা মা অনেক কষ্ট করে আমাকে পড়াশোনা করিয়েছে।
আমি দেশে ফীরে আসলাম। যেহেতু বয়স হয়েছে বাবা মা চাচ্ছিলো আমি বিয়ে করি। বাবা মায়ের পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করতে রাজি হলাম।
মেয়েটিকে আংটি পড়ালাম। সবই ঠিকঠাক ছিলো। বাবা মা অনেক খুশি। বিয়ের কিছুদিন আগে আমি বাজারে গেলাম । বাজার থেকে কিছু জিনিস কিনে টেম্পু ( সি.এন.জি এর মতো ৩ চাকার গাড়ি) দিয়ে বাড়িতে আসতে ছিলাম। আমি ছিলাম ড্রাইভারের সাথে বসা। টেম্পুটা খুব ভালোভাবেই চলছিলো। হঠাৎ এক গাড়ি এসে টেম্পুতে মুখোমুখি ধাক্কা দেয়। সাথে সাথে টেম্পুর হেন্ডেলটি আমার তলপেটে ঢুকে যায় এবং মাথায় আঘাত পাই। তারপর আমি আর কিছু জানি না।
কয়েকদিন পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। দেখলাম আমি হাসপাতালে। আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। পাশে বাবা মা কান্না করতেছে। তাঁদের চোখ বেয়ে পানি পরছে । বুঝতে পারলাম না কি হলো, কেনোই বাা তাঁরা এত কান্না করছে। একটু পরেই জানতে পারলাম আমি চিরতরে বাবা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। এর পরের দিন, আমি যে মেয়েকে বিয়ে করার জন্য আংটি পড়িয়েছিলাম তার বাবা হাসপাতালে এসে আমার বাবার কাছে আংটি ফিরিয়ে দেয় । আংটি ফিরিয়ে দিয়ে লোকটি চলে যাওয়ার পরেই আমার বাবা স্ট্রোক করে মারা যান। সেই শোকে ১৫ দিন পর আমার মা ও মারা যান। আমি হয়ে গেলাম একা, একদম একা। জীবনে একটু শান্তিও নেই এখন। এত বড় পৃথিবীতে আমি অসহায় হয়ে গেলাম। এরই মধ্যে আমার ব্যাংক একাউন্ট থেকে কেউ একজন আমার সিকনেচার নকল করে টাকা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। বাড়ির জায়গা-জমি, বড় বড় আম বাগান সব সম্পত্তি বিক্রি করে সিঙ্গাপুর যাই উন্নত চিকিৎসার জন্যে। অনেকটাই সুস্থ হই। দেশে এসে চলার জন্য আবার টিউশনি শুরু করি । কিন্তু আমার মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। ডাক্তার দেখানোর পর ডাক্তার বললেন এখন যদি আমি টিউশনি করাই এবং মাথায় চাপ পরে তাহলে আমি পঙ্গু হয়ে যাবো। আমি আর পঙ্গু হতে চাই না। তাই টিউশনি বাদ দিলাম। সব হারিয়ে পাগলের মতো বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকি। অবশেষে এখানে আসি। এখানে আসার পরে এই ছেলেগুলোর সাথে কথা হয়। তারা আমার সমন্ধে কিছুটা জানার পর আমাকে এই ছোট্ট চায়ের দোকানটা দিয়ে দেয়। এখন এখানেই খাই, এখানেই ঘুমাই । আমার অনেক ছাত্র এখন অনেক বড় বড় পজিশনে আছে। তাঁরা চায় আমি তাঁদের সাথে থাকি কিন্তু আমার এখানেই ভালো লাগে।
এর মধ্যে অসংখ্য বার মুখ থেকে ইংলিশের খই ছিটাচ্ছিলেন তিনি।
তখন আমরা পুরো নীরব । দীর্ঘ একটা নি:শ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করলাম আপনি এখন কারও কাছে, সাহায্য চাইলে তো পাবেন এবং ভালো কাজ করতে পারবেন৷
আংকেল::আমি কারও কাছে মাথা নতো করতে রাজি না। আমি কাউকে তেল মাখতে পারবোনা।
বাদশার বাদশাহী না থাকলেও তার বাদশাহী স্বভাব থেকে যায়...