চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি? এর সুফল ও কুফল permanent settlement

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলতে কি বুঝ? এর সুফল ও কুফল বর্ণনা করঃ


সুপ্রাচীনকাল হতে ব্রিটিশ বিজয় অব্দি এদেশে অনেক রাজনৈতিক, উত্থান-পতন ঘটেছে,কিন্তু এর ফলে সনাতন জীবনযাত্রার প্রবহমানতায় কখনো কোন বিঘ্ন ঘটেনি।
"পূর্ববর্তী শাসকদের মতো কোম্পানি কেবল শাসন করার বা বংশীয় আধিপত্য কায়েমের উদ্দেশ্যে রাজ্যস্থাপন করেনি। কোম্পানি রাজ্যস্থাপন করেছে বাণিজ্যিক ও অধিকতর মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে। এই রাজ্যের অন্যতম স্থপতি ওয়ারেন হেস্টিংস এর ভাষায়,
 
"এদেশের উদ্বৃত্ত রাজস্ব দেশে পাচার করাই
ছিল এদেশের বৃটিশ আধিপত্য স্থাপনের
                                       অন্যতম লক্ষ্য। "
 
কোম্পানি কতৃক প্রবর্তিত দ্বৈত-শাসন (১৭৬৫-৭২)ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসকে কোম্পানির গভর্নর জেনারেল করে পাঠানো হয়। তিনি বাংলায় দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটান এবং বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্যে জমিদারদের সাথে 'পাঁচসালা ভূমি বন্দোবস্ত ' করেন। তবে নানা কারণে এ ব্যবস্থা ফলপ্রসু না হলে তিনি ১৭৭৭ সালে' একসালা বন্দোবস্ত ' করেন।  রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এটিও ফলপ্রসু হয়নি৷ এমতাবস্থায় গভর্নর জেনারেল লর্ড-কর্নওয়ালিশ নানা বিচার-বিশ্লেষণ করে ১৭৯৩ সালে ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক নতুন প্রথার প্রবর্তন করেন- যা ইতিহাসে 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' নামে পরিচিত।  আরও সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয়-
"১৭৯৩ সালে কর্নওয়ালিস প্রশাসন কতৃক ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও বাংলার ভূমি          মালিকদের ( সকল শ্রেণির জমিদার ও স্বতন্ত্র তালুকদারদের) মধ্যে সম্পাদিত একটি স্থায়ী চুক্তি হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। "
এ চুক্তির আওতায় জমিদার ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হন। জমির স্বত্বাধিকারী হওয়া ছাড়াও জমিদারগণ স্বত্বাধিকারের সুবিধার সাথে চিরস্থায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় এক নির্ধারিত হারের রাজস্বের জমিদারিস্বত্ব লাভ করেন।
বাংলার (ভারতের) ইতিহাসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। কেননা,  এই ব্যবস্থা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যের ভূমি ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় এক বিরাট পরিবর্তন আনে৷ এই পরিবর্তনে সুফল ও কুফল উভয়ই রয়েছে।
। 


 
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলসমূহঃ-
 
 
১) কৃষি উন্নয়নঃ
জমির উপর স্থায়ী মালিকানা লাভ করায় জমিদারগণ জমির উন্নয়নে সাধ্যমত চেষ্টা করেন। এতে জমির  শক্তি এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফলে কৃষি অর্থনীতি চাঙ্গা হয়।
 
২) বাজেট প্রনয়ণ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নঃ
জমি থেকে সরকারের নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আদায় নিশ্চিত হয়। ফলে কোম্পানির বাজেট প্রণয়ন   ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সুবিধা  হয়।
 
৩) সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ়করণঃ
এই ব্যবস্থায় ইংরেজ অনুগত একটি জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি হয়। এ শ্রেনী এ দেশে ব্রিটিশ শাসনের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিকে সুদৃঢ়করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
 
৪) গ্রামীণ সমাজ-ব্যবস্থায় গতিশীলতা সৃষ্টিঃ
নবসৃষ্ট বিত্তবান জমিদারদের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ডে অর্থ ব্যয়ের ফলে গ্রামীণ সমাজ জীবনে গতিশীলতা আসে। এভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত  গ্রাম-বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটায়।
 
৫)উৎখাতের আশঙ্কার অবসানঃ
কৃষকের রাজস্বের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট হয়। ফলে তারা ইজারাদের শোষণ এবং জমি থেকে উৎখাতের আশঙ্কা থেকে মুক্তি লাভ করেন৷
 
 
 
 
 
চিরস্থায়ী  বন্দোবস্তের কুফলসমূহঃ
 
 
 ঐতিহাসিক হোমস বলেছেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল একটি দুঃখজনক ভূল (The permanent settlement was a sad blunder)
প্রকৃতপক্ষে এই বন্দোবস্তের সুফল অপেক্ষা কুফলই বেশি ছিলো।
 
১) কৃষকদের উচ্ছেদঃ
এই বন্দোবস্তে জমিদার জমির মালিকানা পায়, কৃষকেরা নয়। ফলে, বেশি রাজস্বের আশায় জমিদার চাষিকে ঘনঘন জমি থেকে উৎখাত করতেন। এজন্য পার্সিভ্যলিস্পিয়ার বলেছেন,চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা কৃষকরা জমিদারদের ভাড়াটে মজুরে পরিণত হয়।  ফলে কৃষকরা হয় ইচ্ছাধীন প্রজা।
 
২) পুঁজিপতি শ্রেণির প্রকাশঃ
কোন জরিপের ভিত্তিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত না হওয়ায় অনেক জমিদারিতে মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব ধার্য করা হয়। ফলে অনেক জমিদার নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে, সূর্যাস্ত আইনে জমিদারি নিলামে বিক্রি হয়ে যায়৷ তখন এগুলো ক্রয় করে নেয় পুঁজিপতি, বেনিয়া মুৎসুদ্দী মহাজনশ্রেণী।
 
৩) মুনাফা লোভী সৃষ্টিঃ
নতুন জমিদারদের অনেকেই ছিলেন অনভিজ্ঞ। এরা ছিলেন শহরবাসী। ভূমির সাথে এদের সংযোগ না থাকায় ভূমিতে মধ্যসত্বভোগী শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। মুনাফা লোভী এ মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী কৃষকদের নানা রকম নিপীড়ন ও নির্যাতন করতেন।
 
৪) শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ ব্যাহত হয়ঃ
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ বন্ধ করে দেয়। কেননা অনায়াসে সম্পদ ও মর্যাদা লাভের আশায় পুঁজিপতি শ্রেণী ভূমিতে মূলধন বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। অতিরিক্ত করারোপ এবং সরকারের নিরুৎসাহিত করার ফলে শিল্প ও বাণিজ্য খাতে পুঁজি বিনিয়োগ হ্রাস পায়। ফলে শিল্প ও বাণিজ্য ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়।
 
৫) মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর প্রভাবঃ
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এদেশের মুসলমান সম্প্রদায় যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে যায়। কেননা, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব প্রশাসন হতে মুসলমানদের বিতাড়িত করা হয়৷ কিন্তু মুসলিম আমলে রাজস্ব  প্রশাসনের উচ্চ পদগুলো ছিল মুসলমান অভিজাতদের একচেটিয়া দখলে। নতুন ব্যবস্থায় মুসলিম অভিজাতগণ ভূমির সাথে তাদের সাবেক সমন্ধ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান৷ ফলে তারা মারাত্মকভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন।
 
 
 
 
 
তথ্যসূত্রঃ
. অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১;চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কৃষি অর্থনীতি; প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ১৯৯৩; পৃ-২৬৩-৬৪
 
. বাংলাপিডিয়া ; click here to go original link
.উইকিপিডিয়া ;click here to go original link
 
 
তথ্য সহায়িকাঃ
 
📗📗📗
ইতিহাস দ্বিতীয় পত্র (HSC); বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ;প্রকাশকাল -নভেম্বর ১৯৯৮; সংস্করণঃ জুন ২০০৯;পুন-মুদ্রণঃ২০১৪; প্রকাশনা মুদ্রণ ও বিতরণ বিভাগ বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর -১৭০৫


আরও পড়ুনঃ




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url